সরকারের সমালোচনার মুখে জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস করার উদ্যোগ

জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানোর যৌক্তিকতা প্রচারের জন্য  মন্ত্রিসভায় আদেশ দিলেও সরকার এখন মূল্য হ্রাস করার জন্য  উপায় খুঁজছেন। এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য  বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন-বিপিসি এবং পেট্রোবাংলাকে আদেশ দিয়েছে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়।

তেলের মূল্য বৃদ্ধির থেকে পিছু হটার ইঙ্গিত

গত ৫ আগস্ট মাঝরাত থেকে ডিজেল এবং কেরোসিনের মূল্য লিটার প্রতি ৩৪ টাকা ও পেট্রল এবং অকটেনের লটার প্রতি মূল্য  ক্রমান্বয়ে ৪৪ ও ৪৬ টাকা করে বৃদ্ধির  প্রতিক্রিয়ায় প্রচন্ড সমালোচনার মুখে মূল্য বৃদ্ধির থেকে পিছু হটার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

জ্বালানি বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করতে অনিচ্ছুক বলেন, ‘জ্বালানি তেলের মূল্য হ্রাস করার প্রস্তাবনা তৈরি করতে ইতিমধ্যে বিপিসি ও পেট্রোবাংলাকে আদেশ দিয়েছেন সরকার। জ্বালানি বিভাগের দেয়া এই আদেশে আমদানি খাতে কতটা ভ্যাট ও ট্যাক্স কমিয়ে কীভাবে তা জনগণের সহনীয় মাত্রায় রাখা যায়, তার বিস্তারিত তুলে ধরতে বলেছেন মন্ত্রনালয়।’

তিনি জানান, ‘এই প্রস্তাবনা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে প্রদর্শন করা হবে। পরে তা অনুমতি পাওয়া গেলে এনবিআরের কাছে পাঠানো হবে।’

তেলের মূল্য বৃদ্ধির দায় নিতে চায়না বিপিসি

তেলের দাম বাড়ানোর দায় নিজেরা না নিয়ে তা জাতীয় রাজস্ব বিভাগের (এনবিআর) কে দোষারোপ করছে জ্বালানি বিভাগ। জ্বালানি তেল এবং এলএনজি আমদানি বাবদ উচ্চহারের ট্যাক্স ও ভ্যাট বাবদ সরকার বড় ধরনের রাজস্ব আদায় করে থাকে। জ্বালানি আমদানির ভ্যাট ও ট্যাক্স হ্রসের মাধ্যমে বিপিসির ক্ষতি কমাতে ২০২১ সালেই জ্বালানি বিভাগ এনবিআরকে চিঠি দিয়েছিল।

এতে বলা হয়েছে, ‘এনবিআর আমদানি ট্যাক্স কমিয়ে দিলে একদিকে যেমন বিপিসির ক্ষতি ঠেকানো যাবে, অন্য দিকে ক্ষতি কমাতে এড়াতে দাম বৃদ্ধির ঝুঁকিও নিতে হবে না। ফলে জনগণের ওপর বাড়তি মূলের চাপ সামল দেওয়া যাবে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাবে।’

দাম কম করে হলেও ৩৬ টাকা হ্রাসকরা সম্ভব

গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বলেছে, সব ধরনের কর অপসরণ করলে, প্রতি লিটার ডিজেলের দাম কম করে হলেও ৩৬ টাকা হ্রাসকরা সম্ভব হবে।

ফার্নেস অয়েল, জেট ফুয়েল, ডিজেল এবং অকটেনের আমদানির ওপর কাস্টমস শুল্ক ও অন্যান্য কর বাবদ রাজস্ব কর্তৃপক্ষ প্রায় ৩৪ শতাংশ কর আদায় করে থাকে।

এর ভিতর কাস্টমসকে শুল্ক দিতে হয় ১০ শতাংশ, ভ্যাট বা মূসক ১৫ শতাংশ, অগ্রিম কর ২ শতাংশ ও অগ্রিম আয়কর ২ শতাংশ। বর্তমানে ১১৪ টাকায় প্রতি লিটার ডিজেল হতে ৩৬ টাকা কর আদায় করছে সরকার।

জ্বালানি বিভাগের সেই কর্মকর্তা জানান, জ্বালানি বিভাগে যে  চিঠি পাঠানো হয়েছে তার উত্তরই দেয়নি জাতীয় রাজস্ব বিভাগ। উল্টো আরো বিপিসির হিসাবে জমা থাকা উদ্বৃত্ত টাকা নিয়ে নিচ্ছে সরকার।

কমপক্ষে ২১ মাস লস দিয়ে আগের দামেই তেল বিক্রয় করতে পারত বিপিসি

‘সরকার এই টাকা না নিলে কমপক্ষে ২১ মাস লস দিয়ে আগের দামেই তেল বিক্রয় করতে পারত বিপিসি’- এমটাই জানিয়েছেন বিপিসির সেই কর্মকর্তা।

বিপিসির তথ্য অনুযায়ী ২০১৩-২০১৪ অর্থবছর হতে সংস্থাটি শুল্ক, কর এবং লভ্যাংশ বাবদ সরকারি কোষাগারে ৫৬ হাজার ৩০৯ কোটি টাকা জমা দিয়েছেন।

২০২০- ২০২১ অর্থবছরে সরকারের কোষাগারে ৯ হাজার কোটি টাকা জমা দিয়েছে বিপিসি।

অবশ্য বিপিসির চেয়ারম্যান এ বি এম আজাদ গত বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছে, ২০১৪ সাল হতে সাত বছর লাভ করলেও তার আগের ১৪ বছর টানা ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে বিপিসি। লাভের টাকায় সেই ক্ষতি সমন্বয়ও করতে পারেনি বিপিসি। এমনটাই জানিয়েছেন বিপিসির চেয়ারম্যান।

তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়টি স্থায়ী কিছু নাঃ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ

বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, ‘জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর বিষয়টি স্থায়ী কিছু না। এটা একটি সাময়িক পদক্ষেপ মাত্র। বিপিসিকে দেউলিয়া হওয়ার হাত থেকে বাচাতে এটা করতে হয়েছে।’

তিনি আরোও জানান, ‘আমরা প্রয়োজনে আবারও এটা সমন্বয় করব। সবাইকে ধৈর্য ধারন করতে হবে। সবাই ধৈর্য্য ধারন করলে আমরা এ সংকট সামলাতে পারব।’

করোনা-পরবর্তী সময়ে পুরা বিশ্বেই যখন মূল্যস্ফীতির মধ্যে ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা-পরবর্তী সময়ে বিশ্ব এখন কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করছে। জ্বালানি তেল, গ্যাস, খাদ্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, সার সংগ্রহ করতে দেশে দেশে রিজার্ভের উপর চাপ পড়েছে। এর বাহিরে নয় বাংলাদেশও।

বাড়তি আমদানি খরচ মেটাতে ছয় মাসেই রিজার্ভ কমেছে সাত বিলিয়ন ডলারেরও চেয়ে বেশি। রপ্তানি এবং রেমিট্যান্সের দারুণ ঊর্ধ্বগতিতেও পরিস্থিতি পক্ষে আনা যাচ্ছে না। ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমতে কমতে  ঠেকেছে ৯৫ টাকায়। খোলাবাজারে দাম এর থেকে ২৫ টাকা বেশি।

নতুন করে বেড়েছে পণ্যমূল্যের দাম

খোলাবাজারে ডলারের দাম ১২০ টাকা উঠে যাওয়ার কারনে অর্থনীতি নিয়ে আষঙ্কার কারণে দরপতন দেখা দিচ্ছে পুঁজিবাজারে। এর মাঝে জ্বালানি তেলে দাম বাড়ানোর কারণে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি পাওয়ার পর নতুন করে বেড়েছে পণ্যমূল্য দাম।

আর্থিক চাপ সামলাতে মানুষ খরচ কমানোর জন্য মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে। নির্দিষ্ট ও সীমিত আয়ের মানুষেরা শখ আহ্লাদ বাদ দিয়ে, সন্তানের পেছনে খরচ কমিয়ে আনতে বাধ্য হয়েছে, এমনকি খাবারের খরচও কমিয়ে আনতে বাধ্য হচ্ছেন।

তেলের অতিরিক্ত দাম রাজনৈতিক ভাবেও বিপাকে ফেলেছে সরকারকে।

তেলের অতিরিক্ত দাম রাজনৈতিক ভাবেও বিপাকে ফেলেছে সরকারকে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রমাগত তোপের মুখে সরকারের কার্যত কোনো শক্তিশালী জবাব নেই। এই পরিস্থিতির কারনে আগামী জাতীয় নির্বাচনে সরকারকে চাপে পরতে হতে পারে এমনটাই আশঙ্কা করছেন ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীরাই।

অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সতর্ক করে বলেছেন, তেলের মূল্য বৃদ্ধির কারণে মূল্যস্ফীতি বাড়বে।

তেলের মূল্য বৃদ্ধির দুই দিন পরই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, বিশ্ববাজারে তেলের দাম কমলে দেশেও কমানো হবে তেলের মূল্য।

অর্থমন্ত্রী আরোও বলেছেন, বিশ্ববাজারে তেলের মূল্য কমছে এবং বাংলাদেশ কম মূল্যে ক্রয় করা শুরু করেছে।

তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ অবশ্য বলেছেন, তেলের মূল্য  কমাতে দুই মাসের মতো সময় লাগতে পারে।

সূত্রঃ নিউজবাংলা২৪.কম

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *