সরকারের অর্থ পাচারকারীদের নাম জানার সদিচ্ছা আছে কি??

২০১৪ সালের ২৮ জুন জাতীয় সংসদে সরকার জোরালোভাবে দেশের মানুষকে আশ্বস্ত করেছিলেন  যে আমানতকারীদের নামের তালিকা চেয়ে সুইজারল্যান্ড সরকারকে অনুরোধপত্র পাঠাবেন। পাচার হওয়া অর্থ সুইস ব্যাংক হতে ফেরত আনার জন্য ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে। এরপর হতে প্রতিবছর সরকারের পক্ষ থেকে  আশ্বস্ত করা হচ্ছে।

জাতীয় সংসদে ৩০০ ধারায় বিবৃতি

নানান ধরনের বক্তব্য দেওয়া শুরু হয় ২০১৬ সাল হতে। একই বছরের ১১ জুলাই তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত জাতীয় সংসদে ৩০০ ধারায় বিবৃতি দিয়ে বলেছিলেন, ‘সুইস ব্যাংকে অর্থ পাচারের সংবাদ আসলে  অতিরঞ্জন’।বর্তমান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল ২০২১ সালের ৭ জুন জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের সংসদ সদস্যদের উদ্দেশ্য  করে বলেছিলেন, ‘কারা অর্থ পাচার করে, সেই তালিকা আমার কাছে নেই। নামের তালিকা গুলো যদি আপনারা জেনে থাকেন আমাদের দিন।’ আর সর্বশেষ গত ১০ জুন বাজেট-উত্তর সংবাদ সম্মেলনে সংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের তখনকার গভর্নর ফজলে কবির বলেন, ‘বাংলাদেশ হতে কেউ অর্থ পাচার করে সুইস ব্যাংকে টাকা জমা করেছে, এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই।’

নাতালি চুয়ার্ড, সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূতের বক্তব্য

তথ্য পেতে করনীয়  কী , সে বিষয়ে আমরা সরকারকে জানিয়েছি, কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো তথ্যের জন্য আমাদের কাছে অনুরোধ করা হয়নি। আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। দুই পক্ষের সম্মতির ভিত্তিতে এ ধরনের তথ্য আদান-প্রদান করা সম্ভব এবং সেটি আমাদের তৈরি করতে হবে।বিষয়টি নিয়ে আমরা বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করছি।

তিনি আরও বলেন, ‘বাংলাদেশিরা কত টাকা জমা রেখেছে ওই তথ্য প্রতিবছর সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক দিয়ে থাকে এবং ওই অর্থ  অসাধুপায়ে উপার্জন  করা হয়েছে  কি না, এটি আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয়।’

অতএব নাতালি চুয়ার্ডের বিবৃতি হতে দেখা যাচ্ছে, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা তো দূরের থাক, সুইস ব্যাংক হতে কোনো তথ্য পাওয়ার ব্যবস্থাই করেনি বাংলাদেশ । যদিও আমরা জানি বিশ্বের ১২১টি দেশ সুইস ব্যাংক থেকে ঠিকই আমানতকারীদের তথ্য পাচ্ছে। আসলে অটোমেটিক এক্সচেঞ্জ অব ইনফরমেশন (এইওআই) নামে সুইস ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে তথ্য পাওয়ার একটি আন্তর্জাতিক কাঠামো আছে, যা চালু হয়েছে ২০১৭ সাল থেকে। এর আওতায় যদি কেউ  নিজ দেশে শুল্ক ফাঁকি দিয়ে সুইস ব্যাংকে অর্থ জমা করে, তাহলে সেই তথ্য দিতে বাধ্য থাকে সুইস ব্যাংকগুলো।যে দেশ  ১২১ দেশে সুইস ব্যাংক থেকে তথ্য গ্রহন করে সে তালিকায় নাম নেইরবাংলাদেশের।

ধীরে ধীরে পিছু হটেছে সরকার

অতএব দেখা যাচ্ছে, সরকার আসলে সুবিন্যস্তরূপে সুইস ব্যাংকসহ টাকা পাচারকারীদের বিষয়ে ধীরে ধীরে পিছু হটেছে।  সরকারের কেন এই বিপরীত পথে যাত্রা এ নিয়ে বিভিন্ন কথা বলা হয়। অবশ্য যথার্থ একটি উত্তর পাওয়া গেল গতকাল বুধবার। বাংলাদেশে সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড গতকাল বলেছেন, সুইজারল্যান্ডের কয়েকটি  ব্যাংকে বাংলাদেশের নাগরিকদের জমা করা অর্থের বেশির ভাগ অসাধুপায়ে উপার্জন  করা হয়েছে—এ ধরনের অভিযোগ রয়েছে। তবে বাংলাদেশ সরকার এখন পর্যন্ত সুইস ব্যাংক বা কর্তৃপক্ষের কাছে বাঁধাধরা কোনো তথ্য চায়নি।’ জাতীয় প্রেসক্লাবে ডিপ্লোমেটিক করেসপনডেন্ট অ্যাসোসিয়েশন, বাংলাদেশ আয়োজিত ডিকাব টকে বাংলাদেশে নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত নাতালি চুয়ার্ড এসব কথা বলেছেন।

সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক ২০২২ সালের জুন মাসে প্রচারিত বার্ষিক বিবরণী অনুযায়ী

প্রসঙ্গে, সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক বা এসএনবির ২০২২ সালের জুন মাসে প্রচারিত বার্ষিক বিবরণী অনুযায়ী, ২০২১ সাল শেষে সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের জমা হওয়া অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৮ হাজার ২৭৬ কোটি টাকা। ২০২০ সালে যা ছিল ৫৬ কোটি ২৯ লাখ সুইস ফ্রাঁ বা ৫ হাজার ৩৪৮ কোটি টাকা। সেই হিসাবে এক বছরের তফাতে  বেড়েছে ২ হাজার ৯২৮ কোটি টাকা বা ৫৫ শতাংশ।

সরকার কি প্রকৃত পক্ষে  অর্থ পাচারকাীদের তথ্য জানতে চায়?

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সরকার কি প্রকৃত পক্ষে  অর্থ পাচারকাীদের নাম বা তথ্য জানতে চায়? টাকা পাচার নিয়ে এখন পর্যন্ত সরকারের কেবল পদক্ষেপ ছিল ৮ আগস্টের  বিজ্ঞপ্তি। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ঐ দিন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে  বলেছে, বিদেশে পাচারকৃত টাকা এখন থেকে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে ৭ শতাংশ কর দিয়ে দেশে আনা যাবে। অর্থাৎ অর্থ পাচার করলে শাস্তি না, পাচারকারীর বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নয়, বরং সুবিধা দেওয়ার নীতির বাইরে কোন পদক্ষেপ নিচ্ছে না সরকার। বাকি যা যা করে, তা কেবল মাত্র বক্তৃতায়ই সীমবদ্ধ ছাড়া আর কিছু নয়।

সূত্রঃ প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *